December 23, 2024, 7:40 pm

পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল

অনলাইন ডেস্ক
  • Update Time : Monday, December 14, 2020,
  • 228 Time View

চার মাস ১০ দিন পর চার্জশিট, ৮৩ জন সাক্ষীকে অন্তর্ভুক্ত করে ২৬ পৃষ্ঠার চার্জশিটে ১৫ জনকে অভিযুক্ত, আসামিদের মধ্যে ৯ জন টেকনাফ থানার পুলিশ সদস্য, তিনজন এপিবিএন’র সদস্য এবং তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি। কারাগারে থাকা ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ইন্সপেক্টর প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা জবানবন্দি দেননি। একজন পলাতক।

বিশেষ সংবাদদাতা

বÐল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাÐের মূল পরিকল্পনাকারী টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। ওসি প্রদীপের ইয়াবা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ভিডিও ইন্টারভিউ চাওয়ায় প্রথমে Ðমকি ও পরবর্তীতে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ। গতকাল রোববার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে কক্সবাজারের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করে র‌্যাব। পরে গতকাল বিকালে রাজধানীর কাওরান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন র‌্যাবের মুখপাত্র।

চাঞ্চল্যকর ও দেশবাসীর মনে নাড়া দেয়া মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার চার্জশিট দেয়ার পর গতকাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়, সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবমুক্ত হয়ে চার্জশিট দিয়েছেন। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যা প্রয়োজন এই তদন্তে সবই এসেছে। মামলার রায়ে অপরাধীদের শাস্তি হলে আরো খুশি হবেন বলে জানান তিনি। অন্যদিকে সিনহা হত্যা মামলা বাতিল চেয়ে করা বাহারছড়া ক্যাম্পের সাবেক পরিদর্শক ও মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলীর করা রিভিশন আবেদন খারিজ করেছেন আদালত। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আবেদনটি খারিজ করে দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাদী পক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, হত্যাকাÐ তদন্তের ভার র‌্যাব পাওয়ার চার মাস ১০ দিন পর তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছেন। ৮৩ জন সাক্ষীকে অন্তর্ভুক্ত করে ২৬ পৃষ্ঠার এই চার্জশিটে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জ গঠন করেছেন তিনি। এই ১৫ আসামির মধ্যে ৯ জন টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্য, তিনজন এপিবিএন’র বরখাস্ত হওয়া সদস্য এবং তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি। ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে আছেন। একজন পলাতক রয়েছেন। কারাগারে থাকা ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন তাদের নিজ নিজ দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতারকৃত দুই আসামি ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাশ এবং কনস্টেবল রুবেল শর্মা জবানবন্দি দেননি।

তিনি আরো বলেন, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুব স্পষ্টভাবেই একটি বিষয় সামনে এনেছেন। ঘটনার সাক্ষী, আলামত, আসামিদের জবানবন্দির মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠভাবে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাÐ। এই হত্যাকাÐের মূল পরিকল্পনাকারী টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ। হত্যাকাÐ ধামাচাপা দেয়া এবং অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছেন। ইন্সপেক্টর প্রদীপ প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন আপর আসামি এসআই লিয়াকত আলী, মো. নুরুল আমিন, পুলিশের সোর্স মুহাম্মদ আয়াজ ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন। আবার লিয়াকত আলীকে সহযোগিতা করেন আরেক পুলিশ সদস্য নন্দ দুলাল। পাশাপাশি এপিবিএন’র তিন সদস্যের সহায়তায় এ হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে ওই ফাঁড়ির আরও পুলিশ সদস্য সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করার এবং ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ঘটনার বর্ণনায় যা বলল র‌্যাব

র‌্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, জুলাই মাসের ৭ তারিখে মেজর অব. সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও রূপতি মিলে নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করেন। ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিও ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য তারা টেকনাফে গিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে রূপতি ফিরে আসে। সে সময় সেখানে বেশ কিছুদিন থাকার সময়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। তাদের কাছ থেকে ওসি প্রদীপের ইয়বা বাণিজ্য নিয়ে নানা বিষয় জানতে পারেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। এ বিষয়ে সিনহা ক্যামেরাসহ ওসি প্রদীপের কাছে বক্তব্য নিতে যান। সে সময়ে ওসি প্রদীপ তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে যায়। বক্তব্যের পরিবর্তে তাদেরকে টেকনাফ ছেড়ে চলে যাবার জন্য সরাসরি হুমকি দেন।

 

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, মূলত দুটি কারণে ওসি প্রদীপ এই ঘটনাটি ঘটান। একটি হলো, ওসি প্রদীপের ইয়াবা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়। অপরটি, সিনহা এই তথ্য যেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানতে পারেন। হুমকির পরেও যখন মেজর সিনহা রাশেদ তাদের ইউটিউব চ্যনেলের কাজ ও ইয়াবা অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন, তখন ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও ওসি প্রদীপসহ অন্যরা পরিকল্পনা করে এই ঘটনা ঘটান।

চার্জশিটে এসপি মাসুদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত

লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ঘটনার পূর্ব থেকেই ওসি প্রদীপ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন কক্সবাজার জেলার সাবেক পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ। এই ঘটনাটি ঘটার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করা। সিনহা রাশেদকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করাসহ বেশ কিছু কারণে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি অপেশাদারী আচরণ করেছেন বলে মনে করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য চার্জশিটে একটি সিদ্ধান্ত উপস্থাপনা করা হয়েছে বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা।

কী ছিল সিনহার ল্যাপটপে

র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেন ঘটনার দিন রাতে নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালায় টেকনাফ থানা পুলিশ। পরবর্তীতে সেখান থেকে তারা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের ল্যাপটপ উদ্ধার করে। সেই ল্যাপটপ প্রথমে টেকনাফ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সাক্ষ্য প্রমাণ ও সাক্ষীর জবানবন্দি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, সিনহার ল্যাপটপে যে ডিজিটাল কনটেন্ট ছিল, সেগুলো তারা থানায় বসে ধ্বংস করে। ল্যাপটপে এমন কিছু ভিডিও ছিল যা প্রদীপ ও লিয়াকতের অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারে। আমরা ডিজিটাল ডকুমেন্ট অনেক কিছু উদ্ধার করতে পারলেও ওই ভিডিওগুলো উদ্ধার করতে পারিনি। টেকনাফে কী তাহলে পুলিশ এভাবেই সাজানো বন্দুকযুদ্ধ ঘটিয়েছেন, এমন প্রশ্নে আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রতিটি ঘটনাই আলাদা। তারা নির্দিষ্ট একটি ফৌজদারি মামলার তদন্ত করেছেন। এর আগে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক র‌্যাবের গুলিতে নিহত হন বলে জানান তার স্ত্রী। এ সম্পর্কিত তথ্যপ্রমাণ তিনি সংবাদ সম্মেলনে হাজির করেন। ওই মামলার তদন্ত র‌্যাব করেছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ একই জবাব দেন। তিনি বলেন, সংবাদ সম্মেলনটি সিনহা হত্যা নিয়ে।

প্রধান আসামি লিয়াকতের রিভিশন আবেদন খারিজ

সিনহা হত্যা মামলা বাতিল চেয়ে করা বাহারছড়া ক্যাম্পের সাবেক পরিদর্শক ও মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলীর করা রিভিশন আবেদন খারিজ করেছেন আদালত। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আবেদনটি খারিজ করে দেন। গতকাল দুপুর ২টায় এ আদেশ দেন জেলা জজ। তবে পরিদর্শক লিয়াকতের আইনজীবী মাসুদ সালাহ উদ্দীন জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন।

গত ৩১ জুলাই রাত ১০টায় বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। তখনই তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ সব পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনায় ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71